সোমবার, ২৬ মে ২০২৫, ১২:২৩ পূর্বাহ্ন
দৈনিকবিডিনিউজ৩৬০ ডেস্ক : নারীর প্রতি সহিংসতাপ্রতি, ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ- হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কয়েকটি স্থানে ধর্ষণের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে সচেতন মানুষের হৃদয়। রাগ-ক্রোধ আর প্রতিবাদে ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে সমাজ। নারীদের সুরক্ষার দাবিতে এখন রাস্তায় মানুষ। গানে, স্লোগান, বক্তব্য আর লেখনিতে জঘন্য এ কাজের প্রতিবাদ চলছে বিভিন্ন অবস্থান থেকে।
নারীদের প্রতি অত্যাচার শূন্যের কোঠায় কখনওই ছিল না। তবে হঠাৎ চরম মানবিক অবক্ষয়। মেয়েরা প্রয়োজনে বাইরে গেলে এখন ঘরে অস্থির সময় পার করেন বাবা-মা। মেয়েরা সহি-সালামতে ঘরে ফিরলেই কেবল তৃপ্তি ফেরে অভিভাবকদের চোখেমুখে। এমন অবস্থায় কী ভাবছেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবকরা?
জোবেরা রহমান লিনু। দেশের টেবিল-টেনিসের রাণী। পাঁচবার-দশবার নয়, ১৬ বার জাতীয় টেবিল টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নাম লিখিয়েছেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে। ক্রীড়া সংগঠক ও সমাজসেবক হিসেবে এখনও ক্রীড়াঙ্গনে উজ্জ্বল পদচারণা তাঁর। দেড় বছর আগে তার নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘চেয়ারম্যান- অ্যাথলেট কমিশন।’ আইওসির নির্দেশনায় গঠিত যে কমিশনে আছেন দেশের আরও ৫ জন তারকা ক্রীড়াবিদ।
এই অ্যাথলেট কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব হলো ক্রীড়াবিদদের সুরক্ষার বিষয়টি দেখা। খেলার মাঠ ও মাঠের বাইরে ক্রীড়াবিদদের অধিকার, তাদের সুরক্ষা ও স্বার্থের বিষয়টি দেখে তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে সুপারিশ করা। যাতে কারও কোনো সমস্যা থাকলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে দেশের ক্রীড়ার অন্যতম অভিভাবক সংস্থাটি।
গত কয়েকদিন ধরে দেশে আলোচনার শীর্ষে ধর্ষণ। গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনামও দখল করে রেখেছে নিকৃষ্ট এ শব্দটি। ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম অভিভাবক জোবেরা রহমান লিনু অনেকটাই শঙ্কিত খেলাধুলার মেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে। কারণ অতীতে অনেকবার ক্রীড়াঙ্গন থেকেও নারী নির্যাতনের খবর বেরিয়েছে।
চারিদিকে ধর্ষণের এই যে খবর, এই যে ভীতি- এটার ঢেউ যাতে ক্রীড়াঙ্গনে না পড়ে তার জন্য সবাইকে সচেতন হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন সাবেক এই টেবিল-টেনিস তারকা। লিনুর মতে, ‘নিরাপদ সমাজের জন্য ধর্ষণমুক্ত দেশ প্রয়োজন। যেখানে নারী-পুরুষ বলে আলাদা কিছু থাকবে না। সবাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারবেন। ধর্ষণরোধে নির্মম শাস্তি প্রয়োজন, এমন শাস্তি- যা দেখলে কেউ আর এ কাজ করতে সাহস পাবে না। ধর্ষকদের প্রকাশ্যে গুলি করে কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। ধর্ষকরা যাতে পার পেয়ে না যায় সেজন্য তাৎক্ষণিক বিচারের আইন করতে হবে।’
নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে উল্লেখ করে জোবেরা রহমান লিনু বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে যেখানে নারীরা চাঁদে যাচ্ছেন, মঙ্গলে যাওয়ার কথা ভাবছেন, পুরুষের পাশপাশি কাজ করার কথা ভাবছেন, সেখানে দেশে তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা চলছে। এ অপচেষ্টা রুখতে হবে। নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে, নারী ও শিশুদের নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। সবারই দায়বদ্ধতা আছে।’
নারীদের সম্মান করার শিক্ষাটা ঘর থেকে নিতে হবে বলে মনে করেন লিনু, ‘নৈতিকতার শিক্ষাটা ঘর থেকেই সৃষ্টি করতে হবে। নারীদের কিভাবে শ্রদ্ধা করতে হয় বাচ্চাদের সেভাবে কাউন্সিলিং করতে হয়। নারীরা ও শিশুদের খোলা আকাশের নিচে প্রাণভরে নিশ্বাস নেয়ার অধিকার আছে। তারা ঘরবন্দী হয়ে থাকতে পারে না।’
মানববন্ধন নয়, দরকার কঠোর আইন- এমনটা উল্লেখ করে জোবেরা রহমান লিনু বলেছেন, ‘রাস্তায় মানববন্ধন করে লাভ নেই। তাতে শুধু সময় নষ্ট। কঠিন শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রয়োজন। এখন নারীরা অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন। তাদের শুধু গায়ের শক্তি ব্যবহার করে পুরুষরা ধর্ষণ করবে এটা হতে দেয়া যাবে না।’
ক্রীড়াঙ্গনেও এসব অপরাধ হয়। জোবেরা রহমান লিনু মনে করছেন, ‘যে পরিমাণ অপরাধ হয় তার সব প্রকাশ পায় না। কারণ অনেকেই আসে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তারা কোনো অন্যায়ের শিকার হলে মুখ খুলতে চায় না আয় বন্ধ হওয়ার ভয়ে, পরিবার থেকে আর আসতে দেবে না- সে ভয়ে। কিন্তু তাদের মুখ খুলতে হবে, কথা বলতে হবে। তা না হলে এসব ঘটনা বাড়বে। তারা বললেই তো বিচারের ব্যবস্থা সম্ভব। তাই লজ্জা ভাঙ্গতে হবে, সামনে আসতে হবে।’
ক্রীড়াঙ্গনের মেয়েদের সুরক্ষার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেজন্য নভেম্বরে সব ফেডারেশনের প্রতিনিধি এবং সিনিয়র নারী ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকদের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিওএ’র এই অ্যাথলেট কমিশন, ‘আমরা মেয়েদের বোঝাব, সাহস দেবো। কারণ নিজের নিরাপত্তা নিজেদেরও দেখতে হবে। সেটা সবচেয়ে জরুরী। অনেক দুশ্চরিত্রের মানুষ আছে যারা মেয়েদের ছুঁতে পারলেই আনন্দ পায়, পুলকিত বোধ করে। তারা এই মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। যে কারণে সেলফ সিকিউরিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
অনেকে মেয়েদের পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ প্রশ্নের ঘোরবিরোধী লিনু, ‘প্রথমে বলব এ অভিযোগ ঠিক না। এ যুক্তি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বোরকা পরা নারীরাও তো ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। তাই পোষাক নয়, মানসিকতাই বড় বিষয়। তাছাড়া মেয়েরা কী পরবে, না পরবে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। এটা তো অন্যদের দেখার বিষয় নয়। এটা ঠিক মেয়েদের পোশাক শালীন হওয়া ভালো। তাই বলে কেউ অশালীন কাপড় পরল বলে তাকে ধর্ষণ করতে হবে, এটা তো হতে পারে না।’
ক্রীড়াঙ্গনের মেয়েদের সুরক্ষার জন্য ফেডারেশনগুলোকে কঠোর হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন লিনু, ‘ফেডারেশনগুলোকে কঠোর নিয়ম করতে হবে। যদি কারও বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাকে আজীবন বহিস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের অনেক মেয়ে ক্রীড়াবিদ আছে যারা গরীব ঘরের। তাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে, খেলা শেখানোর কথা বলে নিয়ে নিপীড়ন করতে পারে। ফেডারেশনগুলোর উচিত মেয়েদের ডেকে বোঝানো যাতে এমন কিছু ঘটলে তারা নিঃসংকোচে বলে দেয়। তাদের সাহস দিতে হবে। কোনো কিছু ঘটলে বলার জন্য সাহস জোগাতে হবে। বললেই না বিচার পাবে, না বললে তো হবে না।’
দেশের ক্রীড়া প্রশাসনের আরও কঠোর হতে হবে উল্লেখ করে টেবিল টেনিসের রানী বলেছেন, ‘যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের উচিত ফেডারেশনগুলোকে স্ট্রিকলি বলা যাতে কোনো ফেডারেশনে এমন কিছু হলে তাদের কৈফিয়ত দিতে হয়। মেয়েদের খেলাধুলার উন্নয়ন করতে হলে তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা সবার আগে জরুরি।’
এসএস